Magic Lanthon

               

এবিএম সাইফুল ইসলাম

প্রকাশিত ২৪ মার্চ ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

ড. নো থেকে স্কাইফল-৪ : স্নায়ুযুদ্ধের দিক-নির্দেশক বাতি

এবিএম সাইফুল ইসলাম


এক.

স্নায়ুযুদ্ধ সশস্ত্র সংঘর্ষের মতো প্রকাশ্য যুদ্ধ নয়। বিশ্ব-রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ এবং সমগ্র বিশ্বে প্রভাব বিস্তারের প্রয়াসে প্রতিপক্ষকে দুর্বল ও ঘায়েল করার প্রচেষ্টাই ছিলো মূলত স্নায়ুযুদ্ধ। আক্ষরিক অর্থে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী ওয়েস্টার্ন ব্লক এবং সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রগুলোর ইউনিয়ন ইউ এস এস আর-এর (দ্য ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকস) নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক ইস্টার্ন ব্লকের মধ্যে বৈরী রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থাকে স্নায়ুযুদ্ধ বলা হয়।

কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে, ভিন্ন আদলে বিশ্ব পরিসরে স্নায়ুযুদ্ধের স্বরূপ এখনো অনেক ক্ষেত্রেই প্রবাহমান। কারণ, স্নায়ুযুদ্ধের শুরু থেকেই এক শক্তি তার মিত্রদের নিয়ে যেভাবে আরেক শক্তি ও তার মিত্রদেরকে কূটনৈতিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য বিষয়ে চাপে রাখার চেষ্টা করতো; বর্তমানে এর কাঠামোগত কিছু পরিবর্তন হলেও তাদের বিস্তার ও প্রভাব স্পষ্ট প্রতীয়মান। আর জেমস বন্ড সিরিজের চলচ্চিত্র হচ্ছে সাবেক ওয়েস্টার্ন ব্লকের অন্যতম দুই শক্তি¾মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সমন্বিত স্নায়ুযুদ্ধের ‘সাংস্কৃতিক অস্ত্র’। যার যাত্রা শুরু হয়েছিলো সেই ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ড. নো নির্মাণের মধ্য দিয়ে, যা আজ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে সক্রিয়।

দুই.

ইয়ান ফ্লেমিং-এর জেমস বন্ড সিরিজের ষষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে ‘ড. নো’ প্রকাশ হয় ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে। বাস্তবে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ফ্লেমিংকে গোয়েন্দা হিসেবে রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছিলো। ১৯৩৯-এ ফ্লেমিং কমান্ডার হিসেবে ব্রিটিশ নৌ গোয়েন্দায় যোগ দেন। যুদ্ধ শেষ হলে তাকে জ্যামাইকায় পাঠানো হয়। তবে তখনো লেখক হিসেবে ফ্লেমিংয়ের প্রভাব ছিলো সামান্যই। কিন্তু আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি বন্ড সিরিজের উপন্যাস ‘ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ’কে তার প্রিয় ১০ বইয়ের একটি হিসেবে উল্লেখ করলে, হঠাৎ করেই এ সিরিজের বই বিক্রি বেড়ে যায়।

ফ্লেমিং ১৯৫৭’র প্রথম দিকে লিখেছিলেন ‘ড. নো’। ‘কমান্ডার জ্যামাইকা’ নামে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে এন বি সি টেলিভিশনের জন্য একটি নাটকের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন ফ্লেমিং। কিন্তু টেলিভিশন সিরিজের প্রতি আগ্রহ কমে গেলে এবং বন্ড উপন্যাসের বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় নাটকের পাণ্ডুলিপিটি তিনি ‘ড. নো’ উপন্যাসে রূপান্তর করেন। আর জেমস বন্ড চলচ্চিত্র হিসেবে ড. নো নির্মাণের কাজ শুরু হয় ১৯৬১-তে। এ সিরিজের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে তা মুক্তি পায় ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর। সুতরাং, এটা বলা যায় ড. নো সৃষ্টির সময়কাল ১৯৫৬-৬২ খ্রিস্টাব্দ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গোটা বিশ্ব পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়ে আচ্ছন্ন ছিলো। পুরো ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ ইস্ট ও ওয়েস্ট ব্লকের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা, বিশেষ করে মহাকাশ প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৪ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর কক্ষপথে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠায়; পরবর্তী সময়ে আমেরিকাও সফল হয়। এর মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ আপাতদৃষ্টিতে একটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়, যারা তাদের পারমাণবিক হুমকি দিতে পারে। মহাকাশ প্রতিযোগিতার প্রযুক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি¾উভয় উপাদানই জেমস বন্ডের প্রথম কিস্তি ড. নোর মূল প্রতিপাদ্য।

ফ্লেমিংয়ের উপন্যাসে লক্ষণীয়ভাবে কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন সংক্রান্ত সঙ্কটের নানা উপাদান যোগ করা হয়। কিউবায় ১৯৫৬-৫৯ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের ফলে ফিদেল কাস্ত্রো’র নেতৃত্বে কমিউনিস্ট সরকার গঠন হয়। যুক্তরাষ্ট্র এরপর কিউবার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ঔষধ ও খাদ্য ছাড়া প্রায় সব ধরনের জিনিসের রপ্তানি বন্ধ করে দেয় তারা। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র পিগ উপসাগরে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোকে অপসারণের চেষ্টা চালায়।

একটি জিনিস এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিউবার সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক যতো ভালো হয়েছে, উল্টোভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তা ততই খারাপ হয়েছে। কাস্ত্রো ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে নিকিতা ক্রুশ্চেভ’কে গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের অনুমতি দেয়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র নিজের নিরাপত্তা নিয়ে এতই উদ্বিগ্ন হয়েছিলো যে, প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসে কিউবায় বিমান হামলা চালানোর নির্দেশ দেওয়ার একেবারে দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলো। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ থেকে ২৮ অক্টোবর¾এই ১৩ দিন এ নিয়ে যে সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছিলো, তা গোটা বিশ্বকে আতঙ্কিত করে তোলে। সবাই আশঙ্কা করছিলো, এই বুঝি পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত দুটি পরাশক্তি¾যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাচ্ছে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিউবা থেকে মস্কো তাদের ক্ষেপণাস্ত্র প্রত্যাহার করে নেওয়ায় উভয়ে আপাত রণে ভঙ্গ দেয়। তবে যুদ্ধ না হলেও দুই পরাশক্তির মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ বেধে যাওয়ার সব ধরনের আশঙ্কা বিদ্যমান ছিলো। মনে রাখতে হবে, কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে সৃষ্ট সঙ্কটে আপাত ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বিংশ শতাব্দীতে যতগুলো সঙ্কট হয়েছে, তার মধ্যে এটি ছিলো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ যুদ্ধ পারমাণবিক যুদ্ধে রূপ নেওয়ার বড়ো ধরনের আশঙ্কা ছিলো এবং এতে অস্তিত্ব বিলুপ্তির সবচেয়ে বড়ো আশঙ্কার মধ্যে ছিলো গোটা মানবজাতি। কিন্তু কিউবা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তুরস্ক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষেপণাস্ত্র অপসারণে সম্মত হলে ভয়াবহ এ সঙ্কট কেটে যায়।

আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, ফ্লেমিংয়ের উপন্যাস ‘ড. নো’তে এসব দ্বন্দ্বের ভবিষ্যদ্বাণী ছিলো; যার গল্প বলা হয় জ্যামাইকা ও ছোটো কল্পিত দ্বীপ ‘‘ক্রাব কী’’কে নিয়ে। এই দ্বীপে ড. জুলিয়াস নো নামে পাগলাটে এক জার্মান-চিনা বিজ্ঞানী বাস করতো। যে কাজ করতো আন্তর্জাতিক অপরাধ সংস্থা SPECTRE-এর (Special Executive for Counter-intelligence, Terrorism, Revenge and Extortion) হয়ে। যার পরিকল্পনা ছিলো অটোমিক-পাওয়ার্ড রেডিও বিমের মাধ্যমে আমেরিকান মহাকাশ কর্মসূচি ব্যাহত করা।

বাস্তবতা ও কল্পনার সমান্তরালে উপন্যাসের এসব ঘটনা সহজেই মানুষকে আকৃষ্ট করেছিলো। কারণ চলচ্চিত্রে প্রথমত, সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শে সমমনা ক্যারিবিয় একটি দ্বীপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমস্যা দেখানো হয়; যার মাধ্যমে রূপক অর্থে কিউবার কথাই বলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের কাল্পনিক রকেট উৎক্ষেপণ, যা বাস্তবে মহাকাশ অভিযানকেই প্রতিফলিত করে। আর দ্বীপের রেডিওঅ্যাক্টিভিটি নির্দেশ করে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রকে। বাস্তব বিশ্বের দ্বন্দ্বের সঙ্গে জেমস বন্ডকে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে দেখানো হয় এখানে।

মনে রাখতে হবে,‘‘ড. নো’ ছিলো বন্ড সিরিজের ষষ্ঠ উপন্যাস। কিন্তু এটা নিয়েই নির্মাণ হয় প্রথম চলচ্চিত্র। কারণ সমসাময়িক স্নায়ুযুদ্ধের আধেয় হিসেবে ‘ড. নো’-ই ছিলো প্রাসঙ্গিক ও আধুনিক ।

তিন.

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জেমস বন্ডকে কেনো ব্রিটিশ সিক্রেট এজেন্ট হিসেবে জনপ্রিয় করে তোলা হলো? ব্রিটেন ভৌগোলিকভাবে রাশিয়া ও আমেরিকার মাঝখানে অবস্থিত। ফলে অনেক ক্ষেত্রে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সঙ্কটে বিচারকের ভূমিকা গ্রহণ করে ব্রিটেন। ব্রিটেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়া ও আমেরিকা উভয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়। কিন্তু ব্রিটেনের সাম্রাজ্য আস্তে আস্তে নিভে গেলে বৈশ্বিক মঞ্চে সমান শক্তি হিসেবে রাশিয়া ও আমেরিকা আবির্ভূত হয়।

আর ব্রিটেন হচ্ছে রাশিয়া ও আমেরিকার বাইরে বিশ্বের তৃতীয় কোনো দেশ, যারা সেই সময় পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেছিলো। ড. নো (১৯৬২) প্রিমিয়ারের ১০ বছর দুই দিন আগে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ৩ অক্টোবর ব্রিটেন প্রথম পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ করে; যা ছিলো ইউ এস এস আর-এর পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির তিন বছর পরের ঘটনা। আর ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেন তাদের নিজস্ব মহাকাশ কর্মসূচি গড়ে তুলেছিলো, যা এখনো আমেরিকার প্রতিযোগী। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে নিজের অবস্থান ধরে রাখতেই আমেরিকার সঙ্গে ব্রিটেন সুসম্পর্ক বজায় রাখে। আর উপন্যাস ও চলচ্চিত্রে এ কাজটিই করে আসছেন জেমস বন্ড ড. নো (১৯৬২) থেকেই; যিনি আমেরিকার বন্ধু এবং সি আই এ এজেন্ট ফেলিক্স লেইটার দ্বারা প্রভাবিত।

চার.

স্নায়ুযুদ্ধের আধেয়নির্ভর চলচ্চিত্র হিসেবে ড. নো ছিলো প্রথম। কিন্তু অবশ্যই একমাত্র চলচ্চিত্র ছিলো না। এটা কেবল ধারাবাহিক পারমাণবিক হুমকি ছিলো না, একই সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক জাতির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিলো। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আমেরিকা এবং সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ইউ এস এস আর-এর মধ্যকার এই স্নায়ুযুদ্ধের থিম অনেক বন্ড চলচ্চিত্রের মধ্যে সঞ্চারিত হতে দেখা যায়। আর সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো নিজেদের মধ্যে খুব কমই শত্রুভাবাপন্ন ছিলো। উদাহরণ হিসেবে ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ-এ (১৯৬৩) প্রযোজক তাদের সত্যিকারের শত্রু হিসেবে ফ্লেমিংয়ের উপন্যাসে সোভিয়েত এজেন্সি SMERSH-এর নাম ব্যবহার না করে কাল্পনিক নাম SPECTRE ব্যবহার করে। একইভাবে ইউ অনলি লাইভ টোয়াইস (১৯৬৭) ও দ্য স্পাই হু লাভড মিতে (১৯৭৭) একই ধরনের গল্প ব্যবহার করে। যেখানে পশ্চিমা হিসেবে বহিরাগত বাহিনীকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে দেখা যায়।

স্নায়ুযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়-ঘটনা পরবর্তী সময়ে অন্যান্য প্রায় সব বন্ড চলচ্চিত্রেই দেখা যায়। যেমন :গোল্ডফিঙ্গার-এ (১৯৬৪), গোল্ডফিঙ্গার আমেরিকার ফোর্ট নক্স-এ সংরক্ষিত স্বর্ণের মজুদ নষ্ট করতে কোবাল্ট ও আয়োডিন পারমাণবিক ডিভাইস ব্যবহারের মাধ্যমে চিনা পরমাণু বিজ্ঞানীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। যাতে করে চিন পশ্চিমে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারবে বলে মনে করা হয়। কিন্তু ফ্লেমিংয়ের মূল উপন্যাসে গোল্ডফিঙ্গার চিন নয়, বরং SMERSH ও রাশিয়ার হয়ে কাজ করে। থান্ডারবল-এ (১৯৬৫) দুটি ব্রিটিশ পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করে ব্রিটেন ও আমেরিকার প্রধান শহরগুলো ধ্বংস করার হুমকি দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউ এস এস আর উভয়ের মহাকাশযান অন্তর্ধান নিয়ে একে অন্যকে দোষারোপ করা হয় ইউ অনলি লাইভ টোয়াইস-এ। আর এই সঙ্কট সমাধানে একমাত্র নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে ব্রিটেন প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করে পারমাণবিক যুদ্ধের কবল থেকে উভয়কে রক্ষা করে। দ্য ম্যান উইথ দ্য গোল্ডেন গান-এ (১৯৭৪) কুখ্যাত গুপ্তঘাতক স্কারাম্যাঙ্গা বসবাস করেন চিন সমুদ্রের মধ্যে। যিনি গুপ্তহত্যার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ দিয়ে তার চিনা মালিকের জমির ভাড়া শোধ করেন।

আলবেনিয়ার উপকূলে একটি ব্রিটিশ পারমাণবিক সাবমেরিন নিমজ্জিত হতে দেখা যায় ফর ইয়োর আইস অনলিতে (১৯৮১)। যেখানে মিসাইল নিক্ষেপের জন্য তৈরি টপসিক্রেট ATAC ডিভাইস ছিলো। আন্তর্জাতিক মাদক বিক্রেতা ক্রিস্টেটস এই ডিভাইস রাশিয়ার কে জি বি’র কাছে বিক্রির পরিকল্পনা করে। অক্টোপুসিতে (১৯৮৩) বিশ্বাসঘাতক রাশিয়ান জেনারেল অরলভ পশ্চিম জার্মানির একটি আমেরিকান সামরিক ঘাঁটিতে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করে। অরলভ বিশ্বাস করতো, এই বিস্ফোরণের দায় পড়বে আমেরিকার কাঁধে আর এর পরিণতি হিসেবে তাদের বাহিনী ইউরোপ ত্যাগ করবে। ফলে রাশিয়া বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইউরোপ নিয়ন্ত্রণ করবে।

অ্যা ভিউ টু অ্যা কিল-এ (১৯৮৫) এক সাবেক কে জি বি এজেন্ট আমেরিকার সিলিকন ভ্যালি ধ্বংসের পরিকল্পনা করে। কিন্তু বন্ড তা রুখে দেয়। দ্য লিভিং ডেলাইটস-এর (১৯৮৭) কাহিনি গড়ে উঠেছে রাশিয়ার অস্ত্র বণ্টন, আফিম চোরাচালান এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্ব নিয়ে। যদিও গোল্ডেনআই (১৯৯৫) ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে শুট করা হয়েছিলো; কিন্তু তবুও এখানে স্নায়ুযুদ্ধের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বস্তুত, ওপেনিং ফ্ল্যাশব্যাক সিকোয়েন্সে এমন কিছু ঘটনা দেখানো হয়, যার মাধ্যমে বোঝানো হয় বন্ডের প্রকৃত শত্রু হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এ দিয়ে বোঝা যায়, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার আক্ষরিক অর্থে স্নায়ুযুদ্ধের সময় শুরু হলেও তা এখনো বিদ্যমান।

একজন অসাধু সংবাদপত্র মালিকের চক্রান্তের ফলে চিন ও ব্রিটেনের একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা নিয়ে টুমরো নেভার ডাইস-এর (১৯৯৭) কাহিনি গড়ে উঠেছে। কাজাখস্তান ও ইস্তাম্বুলে পারমাণবিক উপাদান সংশ্লিষ্ট কাহিনি দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ নট এনাফ (১৯৯৯), আর সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক ইস্যুনির্ভর দুই কোরিয়ার দ্বন্দ্ব নিয়ে ডাই এনাদার ডে (২০০২)। একইভাবে স্নায়ুযুদ্ধের প্রোপাগান্ডা পণ্য নিয়ে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত জেমস বন্ড সিরিজের প্রথম উপন্যাস নিয়ে ক্যাসিনো রয়্যাল নির্মাণ করা হয় ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে। ক্যাসিনো রয়্যালসহ পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলোতে অনেকটা বাধ্য হয়েই বন্ডকে সমসাময়িকভাবে পুনরুৎপাদন করা হয়। যেমন : বন্ডের সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত স্কাইফল-এর (২০১২) কাহিনি গড়ে উঠেছে উইকিলিকসের জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও জনপ্রিয় টিভি ব্যক্তিত্ব জিমি স্যাভিল’কে নিয়ে। এর মধ্য দিয়ে বোঝানো হয়েছে, পশ্চিমারা ছাড়া অন্য কেউ সাইবার জগতের আসল নির্যাস ও সাম্রাজ্য বিস্তার করলেই তা অপরাধ!

পাঁচ.

জেমস বন্ডের প্রায় প্রতিটি চলচ্চিত্রেই কোনো না কোনোভাবে স্নায়ুযুদ্ধের উপাদান খুঁজে পাওয়া যাবে। এই প্রবন্ধে বিভিন্ন চরিত্র, স্থান, কার্যক্রম ও প্রতীক বিশ্লেষণের মাধ্যমে স্নায়ুযুদ্ধ বন্ডের এসব চলচ্চিত্রে ঠিক কীভাবে চিত্রায়ণ হয়েছে তা আলোচনার চেষ্টা করা হয়েছে।


ক. এখানে প্রথমত জেমস বন্ড, বন্ডগার্ল ও বন্ড ভিলেনদের চরিত্র বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে। বন্ড চলচ্চিত্রে বন্ড চরিত্রটি ড. নোর (১৯৬২) মাধ্যমে আবির্ভূত হয়। ব্রিটিশ এ গোয়েন্দা চরিত্রের কাজ পূর্ব-বিশ্বের হাত থেকে মহামান্য রানিকে রক্ষা করা। যথার্থ রূপক সৈনিক হিসেবে স্নায়ুযুদ্ধকালে তাকে দেখা যায়। যার লক্ষ্য তার ঊর্ধ্বতনকে খুশি করা বা আমলাতান্ত্রিকভাবে উপরে ওঠা নয়, বরং পূর্ব-বিশ্বের ভয়ঙ্কর বিপদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা। এই মিশন যথার্থ করতে তিনি সারাবিশ্ব চষে বেড়ান।

ফ্লেমিংয়ের বন্ডকে চলচ্চিত্রে এমনভাবে জাহির করা হয়েছে, যার মাধ্যমে বোঝা যায়, পশ্চিমা মানুষেরা অন্যদের থেকে অনেক বেশি খোলা মনের। জেমস বন্ড পশ্চিমা সম্পদের বিলাসিতাকে রিপ্রেজেন্ট করে। তার আছে বিলাসবহুল গাড়ি, অত্যাধুনিক বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও ডিভাইস। তিনি বিখ্যাত ভদকা মার্টিনি পান করেন এবং নিয়মিত ক্যাসিনোতে খেলেনজ্জযা করার সামর্থ্য কেবল পশ্চিমা বিশ্বের মানুষদেরই আছে। ‘০০৭’’ চরিত্রটি সম্পূর্ণভাবে নারীবিদ্বেষী। নারীবাদীরা বন্ডের সমালোচনা করেন; কারণ, তিনি নারীদের কেবল ভোগের সামগ্রী হিসেবে দেখে থাকেন। নারীদের সঙ্গ পাওয়ার ক্ষেত্রে সেই নারী কোন দেশের, এটা বন্ডের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। সামগ্রিকভাবে বন্ড চরিত্রটি পশ্চিমা বিশ্বের ক্ষমতা ও আয়েশি জীবনযাপনকে নির্দেশ করে।

দ্বিতীয়ত, বন্ড-নারীরা বন্ড চরিত্রের ওপর বিশেষ ভূমিকা রাখে। বন্ড সাম্রাজ্যের গত ৫০ বছরের ইতিহাসে নারী-চরিত্রের রিপ্রেজেন্টেশন সেই ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়, হানি রাইডার-এর সমুদ্রপাড়ে বিকিনি পরে হাঁটার দৃশ্যের মাধ্যমে। এর মধ্য দিয়ে বোঝানো হয়, সেক্সুয়ালি স্বাধীন ও আকর্ষণীয় নারীরাই বন্ডের সঙ্গে প্রেমবিলাসে মত্ত হয়। একই সঙ্গে এ-ও বোঝানো হয় যে, পশ্চিমা নারীরা সম্পূর্ণভাবে খোলা মনের অধিকারী।

তৃতীয়ত, বন্ড চলচ্চিত্রে ভিলেনকে অন্ধবিশ্বাসী, সঙ্কীর্ণমনা ও নিষ্ঠুর হিসেবে রিপ্রেজেন্ট করা হয়। এরা কোনো না কোনোভাবে সমাজতান্ত্রিক মতবাদে বিশ্বাসী দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। একইভাবে বন্ডের বিপরীতে তাদেরকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন করা হয়।

খ. স্নায়ুযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্থান ও দেশকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রতীকায়িত করা হয় বন্ডের সব চলচ্চিত্রে। যেমন গোল্ডেনআই-এর কথাই ধরুন, সেখানে বার্লিন প্রাচীরের ব্যবহার স্নায়ুযুদ্ধ ও সমাজতন্ত্রের পরিসমাপ্তিকে বোঝায়। বার্লিন প্রাচীরকে এখানে স্নায়ুযুদ্ধের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৬১ থেকে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ প্রাচীর বিদ্যমান ছিলো। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৩ আগস্ট পূর্ব জার্মানি বার্লিন প্রাচীর নির্মাণ করে। ইস্টার্ন ব্লক দাবি করে, ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে খুলে দেওয়া পর্যন্ত এ প্রাচীর পশ্চিম বার্লিন থেকে পূর্ব জার্মানি ও পূর্ব বার্লিনকে স্থলপথে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলো। চক্রান্তকারী ফ্যাসিস্ট শক্তির হাত থেকে পূর্ব জার্মানিকে রক্ষা করে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে এ প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কমিউনিস্ট পূর্ব ব্লক ও পূর্ব জার্মানি থেকে ব্যাপক অভিবাসন ও স্বপক্ষ ত্যাগ রোধে এ প্রাচীর কাজ করেছিলো।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য আশঙ্কা করতো, সোভিয়েত অধিকৃত সেক্টর থেকে পশ্চিম বার্লিনকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে। তারা বার্লিন প্রাচীরকে গোটা বার্লিন দখলে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রচেষ্টার একটি অবসান হিসেবে গণ্য করে। এ দুটি দেশ বুঝতে পেরেছিলো, গোটা বার্লিন দখলের পরিকল্পনা থাকলে সোভিয়েত ইউনিয়ন অযথা প্রাচীর নির্মাণ করতো না।

১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ইস্টার্ন ব্লকের রাজনীতিতে উপর্যুপরি মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। ইস্টার্ন ব্লকের কর্তৃত্ববাদী শাসনে উদারতার সূচনা এবং নিকটবর্তী পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরিতে রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল ঘটে সোভিয়েতপন্থি সরকারগুলোর। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ নভেম্বর ব্যাপক গণঅসন্তোষের মুখে পূর্ব বার্লিন কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান ও ক্ষমতাসীন এস ই ডি’র পলিটব্যুরোর মুখপাত্র গুন্টার শাবোভস্কি’র এক ঘোষণায় এ প্রাচীরের পতন হয়। যা বন্ডের গোল্ডেনআই-এ প্রতীকীভাবে দেখানো হয়।

একইভাবে ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ অন্যান্য যেসব লোকেশন, যেমন : জ্যামাইকা, ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, তুরস্ক, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, মেক্সিকো, ফ্রান্স, বাহামা, জার্মানি, পর্তুগাল, মিশর, নেদারল্যান্ড, লেবানন, চিন, থাইল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, স্কটল্যান্ড, ব্রাজিল, স্পেন, গ্রিস, ইন্ডিয়া, রাশিয়া, জিব্রাল্টার, স্লোভাকিয়া, মরক্কো, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, কিউবা, ম্যাকাও, ভিয়েতনাম, কাজাখস্তান, আজারবাইজান, মোনাকো, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, আইসল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র, উগান্ডা, মাদাগাস্কার, মন্টিনিগ্রো, হাইতি, অস্ট্রেলিয়া ও বলিভিয়ায় চিত্রায়ণ হয়েছে, তার প্রত্যেকটিরই কোনো না কোনো কার্যকারণ আছে। এই উপাদানগুলোর মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ অন্যতম।

গ. যুদ্ধক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত বিষয়, বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে উৎপাদিত সর্বশেষ অস্ত্র ব্যবহারের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায় বন্ডের চলচ্চিত্রে। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে যৌথ মালিকানা বা অর্থনৈতিক যুদ্ধনির্ভর ইস্টার্ন ব্লকের বিরুদ্ধে মুক্তবাজার ও পুঁজিবাদনির্ভর ওয়েস্টার্ন ব্লকের এই যুদ্ধ শুধু রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত নয়, এটা একধরনের প্রযুক্তিগত যুদ্ধও বটে। তাই এক অর্থে এটা গোয়েন্দাদের যুদ্ধও বটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউ এস এস আর-এর মধ্যে সরাসরি বিরোধিতা না থাকার কারণেই গোয়েন্দা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অনেক উন্নত ও আধুনিক হয়ে থাকে। আর এ কারণে দু-পক্ষকেই সমান ও আধুনিক থাকতে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন জরুরি হিসেবে দেখা দেয়; যা জেমস বন্ড চলচ্চিত্রে স্পষ্টভাবে লক্ষণীয়।

যেমন : বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি বা উচ্চ প্রযুক্তিগত অস্ত্র, বিস্ফোরক ব্যবহারের জন্য বন্ড সবসময়ই প্রশংসিত হয়। এই সব অস্ত্র, যন্ত্রপাতি কিন্তু বন্ড বেশিরভাগ সময়ই শত্রুকে হত্যা করার জন্য ব্যবহার করে থাকে। এছাড়া বন্ড সবসময়ই বিখ্যাত ব্র্যান্ডের অত্যাধুনিক বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেন। এই গাড়িগুলোও মিসাইল সমৃদ্ধ। বন্ডের এসব অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে প্রশংসার অর্থ হচ্ছে¾সেই জয়ী হয়, যার কাছে সর্বোৎকৃষ্ট প্রযুক্তি থাকে। সুতরাং এটা হচ্ছে পূর্ব ও পশ্চিমের প্রযুক্তিগত লড়াইয়ের প্রতীক। এ কারণেই অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিগুলোর অতিপ্রাচুর্য থাকে; আর এই অতিপ্রাচুর্যের অর্থ হচ্ছে প্রযুক্তিগত ক্ষমতা। আর প্রযুক্তিগত যুদ্ধ হচ্ছে স্নায়ুযুদ্ধের একটা দৃষ্টিভঙ্গি।

এছাড়া বন্ডের ব্যবহƒত যন্ত্রপাতিগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে¾ক্ষুদ্র নজরদারি ডিভাইস, লুকানো অস্ত্র ও জীবনরক্ষাকারী। এর মধ্যে প্রথম দুটি ধরন বাস্তব দুনিয়ায় বিদ্যমান থাকলেও, তৃতীয়টি সি আই এ বা অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কারণ, এটা অনেকটাই কাল্পনিক।

স্নায়ুযুদ্ধে অত্যাধুনিক গুপ্তচরবৃত্তির বিকাশ হয়েছে। দুই ব্লকই একে অন্যকে ভয় পায়। তাই তাদের একে অন্যকে ভালোভাবে জানতে হয়। এ কারণেই এটা গুপ্তচরবৃত্তির সময়। বন্ড চলচ্চিত্রে অসংখ্য গোয়েন্দা প্রযুক্তি যেমন : গোয়েন্দা প্লেন, স্যাটেলাইট এবং শোনা ও ট্র্যাকিং করার জন্য মাইক্রো প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষ করা যায়। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নয় বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। প্রযুক্তিগত যে নিয়ন্ত্রণ আমেরিকা অর্জন করেছে, সেটা ধরার চেষ্টা করেছিলো ইউ এস এস আর।

প্রযুক্তিগত আইটেমের বাইরে জেমস বন্ড চলচ্চিত্রে এমন কিছু প্রতীক ব্যবহার করা হয়, যা স্নায়ুযুদ্ধের কথা উল্লেখ করে। উদাহরণস্বরূপ মুনরেকার-এর (১৯৭৯) কথা বলা যেতে পারে। যেখানে লাল ফোন ব্যবহার করতে দেখা যায়, যা হোয়াইট হাউস ও ক্রেমলিনকে নির্দেশ করে; এবং একই সঙ্গে যা কিউবা সঙ্কটের পরে পারমাণবিক হুমকি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যায়।

উল্লিখিত আলোচনা ও বিশ্লেষণে এ কথা প্রতীয়মান যে, ওয়েস্টার্ন ও ইস্টার্ন দুই ব্লকের মধ্যে মতাদর্শগত যুদ্ধে বন্ড চলচ্চিত্র পশ্চিমের পক্ষে প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। একই সঙ্গে বর্তমান সময়ে পশ্চিমা সমসাময়িক রাজনীতি ও মতাদর্শকে প্রচারণার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।

জেমস বন্ড চরিত্রটি ও এর স্রষ্টা ফ্লেমিং স্নায়ুযুদ্ধে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ তার একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে¾১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির সঙ্গে একবার ফ্লেমিংয়ের দেখা হয়েছিলো। কেনেডি তখন ফ্লেমিংকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কীভাবে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোকে উৎখাত করা যায়! একই সঙ্গে জেমস বন্ডের মালিকরাও বন্ডকে স্নায়ুযুদ্ধের পণ্য হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কারণ, বিভিন্ন সময়ে বন্ডের রিপোর্টিং পারসন ‘এম’ সরাসরি বন্ডকে স্নায়ুযুদ্ধের সর্বশেষ নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করেন। গোল্ডেনআই-এ ‘এম’ সরাসরি বন্ডকে আখ্যায়িত করেন স্নায়ুযুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ হিসেবে।

তবে সার্বিক বিশ্লেষণ ও আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে, বন্ড চলচ্চিত্র স্নায়ুযুদ্ধ ইঙ্গিতপূর্ণ। বাস্তবতা ও কাল্পনিক¾যে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হোক না কেনো, বন্ড চলচ্চিত্রগুলোকে কোনোভাবেই ঐতিহাসিক বলা যায় না। আর রোজেনবার্গ স্পাই ঘটনা,ইউ-টু (U-2) গোয়েন্দা বিমান কাহিনির মতো বাস্তব ঘটনাগুলো এ গোয়েন্দা নায়কের খ্যাতি এনে দিয়েছে। তাই বন্ডের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে স্নায়ুযুদ্ধকালের মতো বর্তমান সময়েও পশ্চিমারা নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে তাকে একটি ‘সাংস্কৃতিক অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে।

লেখক : এবিএম সাইফুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ান।

mon_mcru@yahoo.com

 

তথ্যসূত্র

১. Willman, Skip (2005:178); ‘The Kennedzs, Fleming, and Cuba: Bond's Foreign Policy’ in Ian Fleming & James Bond: The Cultural Politics Of 007, edited by Edward P. Comentale, Stephen Watt, and Skip Willman, Indiana University Press, 601 North Morton Street, Bloomington, IN 47404-3797 USA.

 

সহায়ক গ্রন্থ

খান, সাহাদত হোসেন (২০১৫); স্নায়ুযুদ্ধ; দি স্কাই পাবলিশার্স, ঢাকা।

Kackman, Michael (2005); Citizen spy : television, espionage, and cold war culture; University of Minnesota Press, 111 Third Avenue South, Suite 290, Minneapolis, MN 55401-2520.

Robin, Ron Theodore (2001); The making of the Cold War enemy : culture and politics in the military-intellectual complex; Princeton University Press, 41 William Street, Princeton, Nwe Jersey 08540.

DiPaolo, Marc (2011); War, politics and superheroes : ethics and propaganda in comics and film; McFarland & Company, Inc., Box 611, Jefferson, North Carolina 28640.




বি. দ্র. প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ম্যাজিক লণ্ঠনের ৯ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ হয়।


এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন